দ্রুত বর্ধনশীল বিদেশী প্রজাতির গাছের বিস্তারের প্রেক্ষাপট

বনজ উৎপাদনের বিশাল চাহিদা পূরণের জন্য, বিদেশী প্রজাতির দ্রুত বর্ধমান প্রজাতির সন্ধানের জন্য সত্তর দশকের শেষের দিকে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। স্বল্প সময়ের মধ্যে কাঠ, খুঁটি এবং জ্বালানী সরবরাহের জন্যে অ্যাকাশিয়া (আকাশমণি) এবং ইউক্যালিপটাস মূলত অস্ট্রেলিয়ান এই দুই প্রজাতির গাছের ব্যাপক হারে প্রসার ঘটানো হয় আমাদের দেশে। ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে UNDP-এর মাধ্যমে এই বিদেশি প্রজাতির গাছ আমাদের দেশে আসে। এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক, বিশ্ব ব্যাংক এবং ইউএসএআইডি এর অর্থায়নে উপজেলা পর্যায়ের “সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি”এবং সরকারের বন বিভাগের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশে ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইউক্যালিপটাস, আকাশমনি, পাইন ইত্যাদি বিদেশি গাছ ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়েছে। এর মধ্যে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি- এই দুইটি গাছ অনেকের কাছে এখন স্থানীয় গাছ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে!

গোটা উত্তরবঙ্গে ছড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত বর্ধনশীল ইউক্যালিপটাস আর আকাশমণি গাছ

যে সব অঞ্চলে বিস্তার
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, পাবনা, যশোর, কুষ্টিয়া এবং পাহাড়ি অঞ্চলের অনেক জায়গায় এমনকি বৃহত্তর সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকার অনেক প্রাকৃতিক বনাঞ্চল খুব দ্রুত ইউক্যালিপটাস ও অ্যাকাশিয়ার বনে পরিণত হয়েছে। এছাড়া এমএলএম কোম্পানি ডেসটিনি গ্রুপ ২০২১ সালের মধ্যে সারা দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রায় এক কোটি পাউলোনিয়া গাছ লাগানোর কাজ শুরু করেছিল ২০১২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে। বাংলাদেশের জীব বৈচিত্র্য এবং দেশীয় প্রজাতির গাছের জন্য এই সকল বিদেশী আগ্রাসী প্রজাতির গাছের বিস্তার হুমকিস্বরূপ। সাধারণত রেইনট্রি, অ্যাকাশিয়া ও ইউক্যালিপটাস জাতীয় গাছে ছেয়ে গেছে আমাদের বনায়ন। এইসব গাছগুলো স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর; এলারজি জাতীয় রোগের উপসর্গকারী হিসেবেও এদের চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশে বহিরাগত প্রজাতির গাছ রোপণের জন্য কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদি কোম্পানি মনসান্তোসহ আরো বেশ কিছু কোম্পানি জড়িত। হাপানি ও এলার্জির ওষুধ বেচার জন্য এনজিও দিয়া একাশিয়া, সেগুন, মেহগনি, ইউক্যালপ্টাস ও আকাশমণি গাছ লাগানোর কাজগুলো এই ধরণের কোম্পানিগুলোর মারফতই ঘটে থাকে।

দাতা সংস্থার দাদাগিরির নমুনা ও প্রভাব
বাংলাদেশে ৮০-এর দশকের শেষের দিকে ‘বিশ্ব ব্যাংক’ বাংলাদেশ সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে কৃষিক্ষেত হতে ‘ব্যাঙ’ ধরে দেয়ার জন্য। সেই সময় কৃষিক্ষেত হতে কোটি কোটি ব্যাঙ ধরা হয়। কিছু দিন পর দেখা যায়, ধানক্ষেতে পোকার আক্রমণ মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং হাজার হাজার ধানক্ষেত পোকার আক্রমনে ধানশূন্য হয়ে পড়ে। এমতাবস্হায় বিশ্বব্যাংক পরামর্শ দেয় উন্নত সার ও কীটনাশক জমিতে ব্যবহার করতে। সরকার বাধ্য হয়ে এগুলো কেনে আর এই খাতে বিশ্ব ব্যাংক অতিরিক্ত শর্তসাপেক্ষে সমস্ত বিনিয়োগ করে এবং চুক্তি সম্পাদন করে। [১]

ইউক্যালিপটাস কি পরিবেশ বান্ধব?
ইউক্যালিপটাসের মত একটি গাছ মোটেও পরিবেশ বান্ধব নয়। একটি পূর্ণবয়স্ক ইউক্যালিপটাস গাছ ২৪ ঘণ্টায় ভূগর্ভ হতে প্রায় ৯০ লিটার পানি শোষণ করে মাটিকে নিরস ও শুষ্ক করে ফেলে। সাধারণত গাছ নাইট্রোজেন গ্রহণ করে আর অক্সিজেন সরবরাহ করে পরিবেশ নির্মল ও প্রাণীকূলের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে সহায়তা করে। অথচ ইউক্যালিপটাস গাছ অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং নাইট্রোজেন নির্গমন করে। এমনকি যে বসতবাড়িতে অধিক পরিমাণে ইউক্যালিপটাস গাছ আছে সেসব বাড়ির শিশু ও বৃদ্ধদের শ্বাসকষ্ট হতে পারে। যে ফলের বাগানে এ গাছের সংখ্যা বেশি সেখানে ফল কম ধরতে পারে। তাই এই ক্ষতিকর গাছ রোপন করা উচিত নয়।

উপকারী দিক কি নেই?
হ্যাঁ আমি মানছি যে এর কিছু উপকারী দিক আছে। যেমনঃ এই গাছের তেলের অনেক ব্যবহার রয়েছে,বিশেষত এন্টিসেপটিক ও পরিস্কারক হিসেবে, মশা নিধনেও এই তেলের ভূমিকা রয়েছে। কাঠ হিসেবে এর রয়েছে ব্যবহার। এর পাতার মধ্যে ফরমিলাটেড ফ্লোরোগ্লুসিনল আছে যা একধরনের এন্টিসেপটিক হিসেবে কাজ করে – সে কারণে এই পাতা বেশিরভাগ পোকা-মাকড়ের জন্য ক্ষতিকারক। এর ফলে অনেক উপকারী পোকামাকড়ও মারা যেতে পারে। এই পাতা পড়ানো ধোয়া দিয়ে মশা-মাছি ও পোকা তাড়ানো হয় অনেক সময়। কাগজ শিল্পের জন্য এই গাছটি খুব প্রয়োজনীয় কারণ গাছটি খুব দ্রুত বাড়ে এর কাঠ মন্ড তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

উপকারিতা বনাম অপকারিতা
কিন্তু উপকারের চাইতে এর অপকারের মাত্রাই বেশী। সঠিক জায়গায় ঠিক মত রোপন না করলে অবশ্যই এই গুনাবলী গুলিই ক্ষতির কারণ হতে পারে। গাছটির কি কি বৈশিষ্ট আছে তা আগে আমরা দেখি – প্রথমত এই গাছটি প্রচুর পানি শোষণ করে। এখন আসি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে – আমাদের দেশে গ্রীষ্ম মৌসুমে বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয় না এবং বেশিরভাগ আন্তঃ নদীগুলো বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে দেয়ার জন্য আমাদের দেশটি বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে আরো শুকনো হয়ে যাচ্ছে যার প্রকোপ উত্তরবঙ্গে প্রকোপ আকার ধারণ করেছে। এইরকম শুকনো জমিতে ইউক্যালিপটাস গাছ রোপন করার মানে নেই। রংপুর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুরের মত জায়গায় ধানের আইলের পাশ দিয়ে মানুষ এই গাছ লাগাচ্ছে কারণ সরকার নাকি ৫ বছরের গাছ বেশ ভালো দামে কিনে নিচ্ছে! আমি সরকারের এই রকম উদাসীনতা দেখে হতবাক হই। আমাদের মত দেশে এই গাছের একমাত্র ভালো ব্যবহার হতে পারে সেইসব জলাবদ্ধ জায়গায় যেখানে বদ্ধ পানি পরিবেশ দূষিত করছে – কয়েক বছর এই গাছ সেখানে বাগানের মত লাগালেই সব পানি নিয়ে নিবে আর তারপর গাছগুলি কেটে ফেলে জায়গাটি ‘রি-ক্লেইম’ করা যায়।

আমি আবার বলছি – ইউক্যালিপটাস অনেক কাজের একটি গাছ কিন্তু আমাদের মত স্বল্প বৃষ্টির ও শুকনো দেশে এই গাছের উপস্থিতি উপকার থেকে অপকার বেশি করছে। আমাদের দেশে এই গাছ লাগানোর কারণ হচ্ছে সল্প সময় কাঠ বানানোর জন্য কিন্তু এই স্বল্প সময়ের লাভের জন্য দেশটিকে মরুকরণের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু যেখানে আমাদের সরকার নিজেই এই গাছ লাগাতে মানুষকে উৎসাহিত করছে সেখানে আমাদের সরকারী বেতনভুক্ত বৃক্ষ ও পরিবেশ বিশারদরা কি করছেন সেটাই আমার প্রশ্ন? যাই হোক – দেশের কোনো অঞ্চলে যদি মাত্রারিক্ত বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা থাকে – সেখানে এই গাছ লাগিয়ে দেশের কাগজশিল্পের কিছু উপকার হয়ত করা যায় – এছাড়া আর কোনো জায়গায় এই গাছ লাগানোর কারণ দেখি না। আরো মৌলিক বিষয় হচ্ছে আমাদের শুধু তেল আর কাঠ না, পাখিদের কথা ভুলে গেলে চলবে না। এইসব আলোচনায় ইউক্যালিপ্টাস ধোপে টিকে না।

এত সবের পর তবে এই দ্রুত বর্ধনশীল গাছের বনায়ন কেন?
এখন প্রশ্ন হোল আমাদের দেশে এত নানা রকমের জলবায়ু উপযোগী গাছ থাকতে দ্রুত বর্ধনশীল গাছের বনায়ন কেন? এ প্রসঙ্গে আমরা প্রকৃতি বিষয়ক লেখক মোকারম হোসেনের মত দেখতে পারি, তিনি ২৪ এপ্রিল, ২০১৩ প্রথম আলোতে লিখেছেন,
“প্রাকৃতিক বনের ধ্বংসাবশেষের ওপর ভিনদেশি বৃক্ষের ক্ষতিকর আচ্ছাদন চরম আত্মঘাতী একটি কাজ। অথচ আমাদের প্রাকৃতিক বনভূমিগুলোয় এই দৃশ্য এখন সবচেয়ে পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে। এখন প্রতিযোগিতা, কত দ্রুত প্রাকৃতিক বন পরিষ্কার করে সেখানে সামাজিক বৃক্ষের নামে কতগুলো বিষবৃক্ষ রোপণ করা যায়। আসলে এর কোনো প্রয়োজনই নেই। বিরক্ত না করা হলে বনগুলো স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃত রূপে আবার ফিরে আসতে পারে। তাই আমাদের উচিত বনকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে না দেখে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা। কারণ, বনভূমিগুলোই মূলত আমাদের পরোক্ষভাবে বাঁচিয়ে রেখেছে।”
অতি সম্প্রতি অ্যাকাশিয়া (আকাশমণি) এবং ইউক্যালিপটাসের বনায়ন জায়েজ করার চেষ্টা
সম্প্রতি আরণ্যক ফাউন্ডেশন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও বন বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অ্যাকাশিয়া (আকাশমণি) এবং ইউক্যালিপটাস গাছের প্রচারণায় নামা দেখে এটা ধারণা করতে কষ্ট হয়না যে তারা তাদের সামাজিক ও মিশ্র বনায়নের নামে বিদেশী দাতা সংস্থাগুলোর অর্থায়নে চলমান প্রকল্পগুলিকে জায়েজ করার চেষ্টা করছে। খোঁজ নিয়ে দেখলে হয়ত জানা যাবে, তাদের এই দুই বিদেশী গাছের বনায়ন নিয়ে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলমান।

সারকথা
নিসর্গ/আইপ্যাক [‘ইন্টিগ্রেটেড প্রটেকটেড এরিয়াজ কনজার্ভেশন (IPAC)] প্রকল্প ২০১৩ সালে শেষ হয়ে গেলেও প্রকৃতি/বন সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে দেশি-বিদেশী গোষ্ঠীর অর্থপ্রাপ্তির আশা শেষ হয়ে যায়নি। পরিবেশ রক্ষায় সরকার এবং এনজিও’গুলোর আন্তঃসম্পর্ক রক্ষা করে ক্রেল [‘ক্লাইমেট-রিজিলিয়েণ্ট ইকোসিস্টেম এণ্ড লাইভলিহুড’(CREL)] এখন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে আরণ্যক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে। তার মানে আইইউসিএন, বেলা, ন্যাকমের মত আপাত দৃষ্টিতে পরিবেশবাদী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাণ-প্রকৃতি-মানুষের স্বার্থ রক্ষার কথা বলে নগদ লাভের চাওয়া-পাওয়ায় বিলীন হওয়ার প্রক্রিয়ায় বলবৎ থাকবে। চলতে থাকবে সরকার কর্তৃক পরিবেশ উন্নয়নের নামে ইউএসএইডের, বিশ্ব ব্যাংকের মত দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর আধিপত্য এবং প্রকৃ্তি/বন সংরক্ষণের আড়ালে প্রাণ-প্রতিবেশবিরোধী কর্মকান্ডের বৈধতা দান। এই ধরণের প্রকল্পে বেনিয়া গোষ্ঠীর নিজস্ব স্বার্থ লুকিয়ে থাকে বলে এসব ক্ষেত্রে সহব্যবস্থাপণার বা কো-ম্যানেজমেন্টের ধারণা হয়ে উঠে একটি নিমিত্তমাত্র, একটি অজুহাতমাত্র। এতে স্পষ্ট হয়ে সরকারী দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে প্রাণ-প্রতিবেশের চাইতে তাদের নিজস্ব ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর মুনাফার স্বার্থ রক্ষার করার বিষয়টি তাদের কাছে সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক, ইউএসএইডের মত দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল দেশীয় অথবা আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী এনজিওগুলোরও অনেক ক্ষেত্রেই কোন স্বাধীন সত্ত্বা থাকেনা, শুধুমাত্র তাদের বেনিয়া স্বার্থের ক্রীড়নক হওয়া ছাড়া। তাই পরিবেশ/প্রকৃতি/প্রতিবেশ রক্ষায় এইসব জাতীয়-আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর বেনিয়াবাজী বন্ধে সর্বজনের শক্তির সম্মিলনের কোন বিকল্প নেই। প্রাণ-প্রকৃতি-মানুষ রক্ষায় সর্বজনের প্রতিরোধই চলমান আগ্রাসন থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়।

তথ্যসূত্রঃ
[১] পরিবেশের রাজনীতি : ড. মাহবুবা নাসরীন।
[২] http://anupsadi.blogspot.com/2012/05/blog-post.html
[৩] Khan, M. T. (2010), The Nishorgo Support Project, the Lawachara National Park, and the Chevron seismic survey: forest conservation or energy procurement in Bangladesh?, Journal of Political Ecology, Vol. 17, pp. 68-78, available at: http://jpe.library.arizona.edu/Volume17/Volume_17.html
[৪] https://sarbojonkotha.files.wordpress.com/2015/09/forest-comp.pdf?fbclid=IwAR2mj5JH-DO69Ho_BjD2dXcBgOhTqzmCUvRow82pqJQ-0Hgt4bCH4YmXmnk

Leave a Reply