আমাদের চারপাশে সবসময়ই নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করা মানুষের ছড়াছড়ি। নেতিবাচক মানুষদের ভীড়ে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করা মানুষজনের দেখা পাওয়া মুশকিল। আমি সবসময়ই চেষ্টা করেছি এসব নেতিবাচক মানুষ থেকে দূরে থাকতে। এতে করে হয়তো ক্ষনিকের জন্যে মনে হতে পারে যে আপনার সামাজিকতার গন্ডি সংকুচিত হয়ে আসছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন এর মাধ্যমে বরং আপনার জীবনে ইতিবাচক সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে।

আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করে আমার জীবনে অল্পবিস্তর যতটুকুই সাফল্য আছে তার পেছনে মূল মন্ত্র কি? আমি এর উত্তরে বলবো, নেতিবাচক কিংবা সবসবসময় কোন বিষয়ে বিরুদ্ধ ভাব ও দৃষ্টিভোঙ্গী পোষণকারী মানুষ থেকে দূরে থাকা।

এই বিষয়গুলি ভালো ভাবে বুঝতে পারি যখন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রবেশ করি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি সেই অর্থে সেরা শিক্ষার্থী ছিলাম না কখনোই। বরং তার উল্টোটা বলা যেতে পারে। তবে অপরপক্ষে প্রথমবর্ষ থেকেই এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটি এর সাথে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু সেক্ষেত্রে নেতিবাচক মানুষজনের সন্ধান পাই। বেশিরভাগ সিনিয়রদের মনোভাব ছিল এরকম যে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে কি লাভ? এর চাইতে সিজিপিএ এর উপর নজর দাও। নাহলে পরে বুঝবে যখন চাকুরীজীবন শুরু করবে। এই একই ধরনের মনোভাব আমি অনেক সম্মানিত শিক্ষক-শিক্ষিকার মধ্যেও লক্ষ করেছি। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, এসকল নেগেটিভ মাইণ্ডের সিনিয়রদের ভোল পালটে যায় যখন এইসব ভলান্টারি কাজ করতে গিয়ে দেশের বাইরে ভ্রমণের আমন্ত্রণ আসে। তখন তারা সবাইও সেরা স্বেচ্ছাসেবী হয়ে বিদেশ বৈভূবে ভ্রমণের আগ্রহ পোষণ করেন। এমনকি কয়েকজন পরবর্তীতে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্যে আবেদনের নিমিত্তে ভুয়া ভলান্টিয়ার সার্টিফিকেট জোগাড় করে দেবার আবদার করেন! সময় আসলেই মানুষের ভোল পালটে দেয়!

নিজ দেশে শিক্ষা জীবনে যেই ভলান্টারি এক্টিভিটি নিয়ে তীর্যক মন্তব্য শুনেছি, সেখানে আমার বর্তমানে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত আছি সেখানকার চিত্র ভিন্ন দেখছি। এখানে প্রতি সামারে শিক্ষার্থীদের জন্যে সামার স্কুল পরিচালনা করা হয়৷ এর বাইরে সারাবছরই বিভিন্ন সোসাইটি কিংবা ক্লাবের কার্যক্রম লেগেই থাকে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় আপনার মাঝে লিডারশীপ কোয়ালিটি বিল্ডাপের চেষ্টা করে যায়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে যেটা দেখে এসেছি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুধু কিছু নির্দিষ্ট চোথা মুখস্থ করে যাওয়া। যিনি যত বেশি মুখস্থবিদ্যায় পটু, তিনি তত বড় শিক্ষার্থী।

এরপর আসা যাক প্রোফেশনাল লাইফ কিংবা ক্যারিয়ার বিল্ডাপের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে আমাদের সবার মনোভাবই ছিল বিসিএস কিংবা নিদেনপক্ষে একটা সরকারি চাকুরী যোগাড় করা। কিন্তু আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে কর্মী নিয়োগের যেই পদ্ধতি, সেটা আমাকে কখনোই সরকারি চাকুরীর জন্যে আগ্রহী করে তোলেনি। তাই আমি এথেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছি কারণ মঙ্গোলিয়ার রাজধানী কিংবা উগান্ডার মুদ্রার নাম তোতাপাখির ন্যায় মুখস্থ করা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।

এবার আশা যাক উচ্চশিক্ষার ব্যপারে। স্কলারশিপ, বাইরে আবেদন কিংবা এই সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে খুব বেশি মানুষের কাছ থেকে পরামর্শ পায়নি। বেশিরভাগই সিজিপিএ শোনার জন্যে উদগ্রীব, এবং সেটার উপর জোড় দিয়ে গেছেন। রিসার্চ কিংবা এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটি এর ব্যাপারে তাদের তেমন কোন আগ্রহ লক্ষ করিনি। বরং অনেকের ক্ষেত্রে উল্টোটা দেখেছি। এবং তারা পরামর্শ দিতেও কম আগ্রহী মনে হয়েছে।

তবে এর মাঝেও অল্প কিছু মানুষকে পেয়েছি যারা এই তথাকথিত ভালো শিক্ষার্থীর মানদন্ডে বিশ্বাসী ছিলেন না। আমি এসকল মানুষদের কাছে কৃতজ্ঞ। তারা তাদের জায়গা থেকে সবসময়ই উৎসাহ দিয়ে গেছেন। আমি তাদের নাম উল্লেখ করতে চাই না। কারণ আমি খুব কম সংখ্যক মানুষদের সাথেই এসব বিষয়ে আলোচনা করতাম এবং তারা সেটা জানেন।

এবার মূল কথায় আসি, আপনি যখন মনোপোষণ করবেন যে আপনি বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্যে আবেদন করবেন তখন আপনি আপনার একাডেমিক এবং নন-একাডেমিক এচিভমেন্ট এবং স্কিলগুলির তালিকা করে নেবেন। এটা মনে রাখবেন শুধু সিজিপিএ দিয়ে বাইরে কোথাও আপনার যোগ্যাতার মূল্যায়ন হয় না। বরং সেটা সিজিপিএ, ইংরেজি দক্ষতা, রিসার্চ এর অভিজ্ঞতা, এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটি কিংবা কাজের অভিজ্ঞতা, মোটিভেশান ও রিকমেন্ডেশন লেটার সব মিলিয়ে একটা প্যাকেজ হিসেবে কাজ করে। তাই কেউ যদি শুধু আপনার সিজিপিএ কম এই কথা বলে তীর্যক মন্তব্য করে তবে হতাশ হবেন না। বরং আপনি উপরে উল্লেখিত অন্য দিকগুলিতে জোর দিন। আপনার সাফল্য আসবেই।

আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলি। আমার মাস্টার্স এর থিসিস এর টপিক দেখে একজন সম্মানিত শিক্ষক মন্তব্য করেছিলেন যে এটা কিছুই হয়নি। এটা কোন রিসার্চ না। আমি যেই সাইটেশন ও রেফারেন্সিং ফরমেট ব্যবহার করেছি সেটাও নাকি ভুল কিংবা ভুয়া। আমাদেরকে যদি একটা কমন কোন ফরমেট ব্যবহার করতে বলা হতো আমি তখন সেটা মেনে নিতাম। কিন্তু সেটা তখন করা হয়নি। তাই উনার সেই মন্তব্যের কারণ বুঝতে পারি নি। মজার ব্যাপার হলো সেই কাজটিই পরবর্তীতে Q1 ক্যাটাগরির জার্নালে প্রকাশিত হয় এবং সেটা আগের সেই ব্যবহৃত সাইটেশন ও রেফারেন্স ফরম্যাট ব্যবহার করেই। তাই এক্ষেত্রেও নেতিবাচক মনোভোবসম্পন্ন মানুষ।

সম্প্রতি করোনাকালে (ইউকে তে এপ্লাই করার পূর্বে) এক অসি ডক্টরাল ডিগ্রীর পথে পথিক একজন মহাজ্ঞানীর কাছে কিছু পরামর্শের জন্যে তাকে নক দেই। কারণ আমি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রফেসরের কাছ থেকে পজিটিভ রেসপন্স পাই এবং তিনি আমাকে এপ্লাই করতে বলেন ও স্কলারশিপের জন্যে আবেদন করতে কন্টাক্ট পারসনের ডিটেইলস দেন। কিন্তু আমাকে সেই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অসি মহাজ্ঞানী বলে দেন আবেদন করে লাভ নাই। আমার আবেদনপত্র গ্রহণ হবে না এই প্রোফাইল দিয়ে। যদিও আমি আবেদন করতে চেয়েছিলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ডিপার্টমেন্টে। কিন্তু উনি ঘোষণা করেন যে সব আবেদনপত্র প্রাথমিক বাছাই উনার হাত দিয়েই হয়। তাই উনি নিশ্চিত আমার হবে না এখানে। যাইহোক আমি তার এই কথা শোনার পর তার সাথে আর কথা বারাই নি। মজার ব্যাপার হলো সেই মহাজ্ঞানী যিনি কিনা সবার নিয়োগ দিয়ে বেরিয়েছেন এখন নিজেই নতুন নিয়োগ পেতে ধরনা দিয়ে বেড়াচ্ছেন!

এরপর যখন ইউকেতে আবেদন করার পর ভর্তি, স্কলারশিপ ইত্যাদি সব ঠিক তখন একজন বললো যে ইউকেতে এসে লাভ নেই। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম কেন আসব না? তখন সে জানাল যে এখানকার সেরা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রী নেওয়ার পরেও সে বছরের পর বছর চেষ্টা করেও কোন জব পাননি। তাই এখানে আসা ঠিক হবে না। আবারও শুরুতেই সেই নেগেটিভ প্রচারণা!

যাইহোক আমিও তার সাথে কথা বাড়ায় নি আর। চুপচাপ যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছি। এর চাইতে বড় বিষয় হচ্ছে, আমার সুপারভাইজার এর সাথে প্রথম সরাসরি মিটিং এর দিনই উনি উনার রিসার্চ গ্রুপে পোস্টডকের জন্যে অফার করেন। যদিও আমি ক্যারিয়ার কোন ফিল্ডে গড়ব সেটা এখনো ঠিক নেই। আর এই গ্রুপেই কাজ করব কিনা তাও জানি না। তবে এটা উল্লেখ করার কারণ একটাই যে যেটা আমি করতে পারি নি সেটা অন্য কেউ করতে পারবে না এমন মনোভাব থাকা মানুষদের কাছ থেকেও দূরে থাকা ভালো। আমি তাদের থেকে দূরেই থাকি।

আরেক গ্রুপ আছে, যারা এটা বিশ্বাস করতে চায়না যে আমি বাংলাদেশ থেকে কমনওয়েলথ কিংবা সরকারি কোন স্কলারশিপ ছাড়াই সরাসরি প্রফেসরের কাছে আবেদন করে ফুল ফান্ডিং সহ ইউকেতে পিএইচডি করার সুযোগ পেয়েছি। এর কারণ তাদের রেজাল্ট অনেক ভালো কিন্তু তারা বছরের পর বছর চেষ্টা করেও সেটা পান নি। মানে আমি পারি নি, তাই অন্য কেউও পারবে না। আমি এই টাইপের মানুষ থেকেও দূরে থাকি।

শেষকথা হচ্ছে, আপনি নিজের উপর আস্থা রাখুন। নিজের কনফিডেন্স থাকলে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করলে আপনাকে কেউ সাফল্য থেকে ফেরাতে পারবে না। তবে হ্যাঁ এটা ঠিক যে একেকজনের কাছে সফলতার সংজ্ঞা একেক রকম। কিন্তু আপনিই সেই সংজ্ঞা ঠিক করবেন। তাই নেতিবাচক মানুষ থেকে দূরে থাকুন, জীবনে ইতিবাচক সম্ভাবনা সৃষ্টি করুন।ধন্যবাদ।

২০.০৩.২০২২

মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (অপু)

পিএইচডি রিসার্চার,

ফুড সিকিউরিটি ফর ইকুইটেবল ফিউচার রিসার্চ গ্রুপ,

ডিপার্টমেন্ট অফ সোশিওলজি,

ল্যাংকেস্টার ইউনিভার্সিটি,

ল্যাংকেস্টার, ইউকে।

#নেগেটিভমানুষ #পজেটিভমানুষ #ক্যারিয়ার #উচ্চশিক্ষা #সাফল্যেরপথ

Leave a Reply